বিহারি সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা

বিহারি সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা

ভূমিকা: বাংলাদেশের ইতিহাসে বিহারি সম্প্রদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিতর্কিত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের সময় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়। সেই সময়ে ভারতের বিহার রাজ্য থেকে বহু মুসলিম পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) অভিবাসন করে। তাদের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ। এই অভিবাসী মুসলিমরাই পরবর্তীতে ‘বিহারি’ নামে পরিচিতি পান। সময়ের পরিক্রমায় তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে ওঠে।
বিহারি সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা


বিহারিদের পরিচয় ও আগমন:

'বিহারি' শব্দটি মূলত ভারতের বিহার রাজ্য থেকে আগত মুসলিমদের বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ধাপে ধাপে তারা পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বিহারিদের এই আগমন ব্যাপকতা লাভ করে। তারা শিক্ষা, অর্থ এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল, তবে পরিশ্রমী ও কর্মঠ জাতি হিসেবে তারা পরিচিত ছিল। নানা ধরনের পেশায় জড়িয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করে।

বাসস্থান:

বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকা, সৈয়দপুর, রংপুর, খুলনা, চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি শহরে বিহারিরা বসবাস করে। তবে সৈয়দপুরে সবচেয়ে বড় বিহারি বসতি গড়ে উঠেছে। তারা সাধারণত গোষ্ঠীভিত্তিক বসবাস করে এবং বংশপরম্পরায় একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে কেন্দ্র করে বসতি গড়ে তোলে। বিহারিদের অধিকাংশই এখনো জাতিসংঘ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করে, যেখানে জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্নমানের।

পেশা:

শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক অবস্থার কারণে বিহারিরা মূলধারার পেশায় প্রতিষ্ঠা পায়নি। তারা সাধারণত কসাই, দারোয়ান, রিকশাচালক, ঠেলাগাড়ি চালক, জুতার কারিগর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত থাকে। আজও কসাই পেশায় বিহারিদেরই বেশি দেখা যায়। এসব পেশা সমাজে নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ায় বিহারিদের প্রতি একটি সামাজিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যা এখনও টিকে আছে।

ভাষা ও শিক্ষা:

বিহারিদের প্রধান ভাষা উর্দু হলেও অনেকেই মৈথিলি, হিন্দি এবং স্থানীয় বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশে বসবাস করার ফলে নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেছে। তবে এখনো ক্যাম্পভিত্তিক বসবাসের কারণে তারা উর্দুকে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে ধরে রেখেছে। বিহারি সমাজে শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও আধুনিক প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক বিহারি শিক্ষার্থী এখন বাংলা মাধ্যমের স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে।

ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার:

বিহারিরা মুসলিম হলেও তাদের বেশিরভাগই শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী। তারা রমজানে রোজা রাখা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, শবেবরাত, শবেকদরের মতো ধর্মীয় উৎসব পালন করে। এছাড়া কারবালার শহীদদের স্মরণে মহররম মাসে তারা শোক পালন করে এবং তাজিয়া মিছিল আয়োজন করে। ধর্মীয় অনুশাসনে তারা কিছুটা গোঁড়া মনোভাবাপন্ন হলেও সময়ের সাথে সাথে অনেক পরিবর্তন এসেছে।

বিবাহ প্রথা:

বিহারি সমাজে বিবাহ একটি পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত বিষয়। তারা সাধারণত নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই পাত্র-পাত্রীর খোঁজ করে থাকে। বিগত দিনে বাঙালি মুসলমানদের সাথে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পরিবর্তন এসেছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাঙালি সমাজের সাথে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে এবং পারিবারিক মেলবন্ধন দৃশ্যমান। তবে যৌতুক প্রথার প্রচলন এখনো বিহারি সমাজে বিদ্যমান।

খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক:

বিহারিদের খাদ্যাভ্যাসে মাংস ও রুটির প্রতি প্রবল ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। যদিও তারা বাঙালিদের মতোই ভাত ও তরকারি খায়, তবে বিশেষভাবে তারা কাবাব, কিমা, নিহারির মতো উর্দুভাষী মুসলিমদের খাবারগুলো বেশি পছন্দ করে। পোশাকের দিক থেকেও তারা কিছুটা পার্থক্য বজায় রাখে। নারীরা সালওয়ার-কামিজ পরিধান করে এবং পুরুষরা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে। বিশেষ অনুষ্ঠানে তারা ঐতিহ্যবাহী উর্দু পোশাক পরিধান করে থাকে।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া:

বিহারিরা ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী মৃত্যুর পর মৃতদেহ দাফন করে। শিয়া সম্প্রদায়ের কারণে তারা কবরস্থানের পাশে সমাধি সৌধ তৈরি করে এবং বিশেষ দিনে সেখানে দোয়া ও মোনাজাত করে থাকে।

বিহারি সমস্যা:

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারিরা পাকিস্তানিদের পক্ষ নেয়। তাদের একটি বড় অংশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাঙালিদের উপর নির্যাতন, হত্যা এবং লুটপাটে অংশ নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অনেক বিহারি প্রতিশোধমূলক হামলার শিকার হন। এরপর থেকে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকত্ববিহীন অবস্থায় ছিল। পাকিস্তান সরকার তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে এবং বাংলাদেশ সরকারও প্রথমদিকে দ্বিধান্বিত ছিল। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় অস্থায়ী ক্যাম্পে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়, যা আজও স্থায়ী হয়নি। নাগরিকত্ব, বাসস্থান ও সামাজিক স্বীকৃতির অভাবে তারা এক প্রকার বঞ্চনার জীবন যাপন করছে।

উপসংহার: বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারিরা একটি স্বতন্ত্র মুসলিম সম্প্রদায় হলেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় রীতিনীতিতে বৈচিত্র্য থাকলেও জীবনযাত্রার মানে পিছিয়ে রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে নতুন প্রজন্ম মূলধারার সমাজের সাথে মিশে যেতে শুরু করেছে। তবে এখনো নাগরিক অধিকার, শিক্ষার সুযোগ ও পুনর্বাসন নিয়ে এই সম্প্রদায় নানা সমস্যার মুখোমুখি। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে সম্পৃক্ত করাই সময়ের দাবি।

No comments:

Post a Comment